MAIN MENU

শিয়াদের ইতিহাস: উৎপত্তি, বিশ্বাস ও কারবালার আত্মত্যাগ


শিয়াদের ইতিহাস: উৎপত্তি, বিশ্বাস ও কারবালার আত্মত্যাগ (A Complete Guide to Shia Islam in Bengali)

📌 প্রথম পরিচিতি

বিশ্বব্যাপী প্রায় দুই বিলিয়ন মুসলমানের একটি বড় অংশ সুন্নি ও শিয়া নামে বিভক্ত। এদের মধ্যে শিয়া মুসলমান হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক গোষ্ঠী, যাদের বিশ্বাস, আচার এবং ইতিহাস ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠেছে।

এই আর্টিকেলে আমরা জানবো:

  • শিয়াদের ইতিহাস ও উৎপত্তি

  • শিয়া সুন্নি বিভাজনের কারণ

  • শিয়াদের মূল আকিদা ও বিশ্বাস

  • কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা

  • শিয়া সম্প্রদায়ের শাখা ও ভৌগলিক বিস্তৃতি

  • এবং সুন্নি-শিয়া মতবাদের মূল পার্থক্য


🕋 শিয়া ইসলামের ইতিহাস ও উৎপত্তি

শিয়াদের ইতিহাসের সূচনা হয় ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর wafat-এর পর। তখন মুসলিম সমাজ একটি কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়: কে হবেন ইসলামের পরবর্তী নেতা?

শিয়া ইসলামের ইতিহাস ও উৎপত্তি শুরু হয় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর wafat (মৃত্যু) এর পর। মুসলিমরা তখন নেতৃত্ব নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল বিশ্বাস করেছিল যে নেতৃত্ব (ইমামত) হযরত আলী (রা.)—যিনি নবীর চাচাতো ভাই ও জামাতা—এর অধিকার। এ বিশ্বাস থেকেই "শিয়া" শব্দটি আসে, যার অর্থ "আলী-এর অনুসারী" (Shiat-e-Ali)। শিয়ারা মনে করে, আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত ইমামগণই প্রকৃত নেতা, যারা নিঃসন্দেহ, নির্ভুল ও আধ্যাত্মিকভাবে শ্রেষ্ঠ। এইভাবে শিয়া মতবাদের ভিত্তি তৈরি হয় রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের প্রশ্নে।

🔹 আলীর নেতৃত্ব দাবির ভিত্তিতে শিয়ার জন্ম

একদল সাহাবী এবং মুসলমান মনে করতেন, হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (আঃ)—নবীজির চাচাতো ভাই ও জামাতা—ই ছিলেন প্রকৃত উত্তরসূরি। এই গোষ্ঠী পরিচিত হয় "শিয়াতু আলী" নামে, অর্থাৎ “আলীর অনুসারীরা”। সেখান থেকেই জন্ম নেয় "শিয়া ইসলাম"


👑 খিলাফত বনাম ইমামত: শিয়া-সুন্নি বিভাজনের মূল কারণ

শিয়া-সুন্নি বিভাজনের মূল কারণ ছিল ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর wafat-এর পর মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব (খিলাফত) নিয়ে মতবিরোধ।

সুন্নিরা মনে করতেন, নবী (সা.)-এর কোনো নির্দিষ্ট উত্তরাধিকার নির্ধারিত ছিল না, তাই সাহাবাদের মতামতের ভিত্তিতে হযরত আবু বকর (রা.)-কে প্রথম খলিফা নির্বাচিত করা হয়।
শিয়ারা বিশ্বাস করতেন, নবী (সা.) স্বয়ং আলী (রা.)-কে তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করেছিলেন এবং ইমামত বা নেতৃত্ব শুধুমাত্র তাঁর বংশধরদের মধ্যেই থাকা উচিত।

এই নেতৃত্বের প্রশ্ন থেকেই ধীরে ধীরে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য তৈরি হয়, যা শিয়া-সুন্নি বিভাজনের ভিত্তি।

বিষয় সুন্নি মুসলমানদের মত শিয়া মুসলমানদের মত
নেতৃত্ব খলিফা নির্বাচিত হন ইমাম আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত
প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) আলী ইবনে আবু তালিব (আঃ)
খলিফার ভূমিকা রাজনৈতিক নেতা আধ্যাত্মিক ও ঈশ্বর-নির্ধারিত নেতা

শিয়া মতবাদের মূল ভিত্তি হলো ইমামত, যেখানে তারা বিশ্বাস করেন, নবী (সা.) নিজে হযরত আলী (আঃ)-কে এবং পরবর্তীতে আলীর বংশধরদের ইমাম হিসেবে মনোনীত করে গেছেন।


🩸 কারবালার ট্র্যাজেডি: শিয়া ইতিহাসের হৃদয়

🔹 হযরত হুসাইন (আঃ)-এর আত্মত্যাগ

৬৮০ খ্রিস্টাব্দে, নবীজির নাতি হুসাইন ইবনে আলী (আঃ) অন্যায়কারী খলিফা ইয়াজিদ-এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত করেননি।

🔹 কারবালার যুদ্ধ

হুসাইন (আঃ) ও তাঁর পরিবারকে ১০ মহরম তারিখে কারবালা নামক স্থানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই ঘটনাকে শিয়া মুসলমানরা আশুরা দিবস হিসেবে গভীর শোক ও স্মরণে পালন করেন।


🧕 শিয়া মুসলমানদের প্রধান আকিদা ও বিশ্বাস

🔸 ১. ইমামত

শিয়ারা মনে করেন, নবীজির পর ১২ জন নির্দিষ্ট ইমাম নির্ধারিত, যাঁরা শুধুমাত্র আলীর বংশ থেকে।

🔸 ২. তাকিয়া

জীবন বাঁচাতে বিশ্বাস গোপন করা অনুমোদিত।

🔸 ৩. আশুরা

প্রতি বছর ১০ মহরমে হুসাইন (আঃ)-এর শাহাদাতকে স্মরণ করে মাতম, শোকযাত্রা ও মহররম পালন করা হয়।

🔸 ৪. মুত'আ (সময় নির্ধারিত বিয়ে)

শিয়াদের একটি বিতর্কিত অথচ অনুমোদিত বিবাহপ্রথা, যা সুন্নিদের মধ্যে প্রচলিত নয়।


🕌 শিয়া মুসলমানদের শাখাসমূহ

✅ ১. ইমামিয়া বা দ্বাদশী শিয়া (Twelver Shia)

  • সবচেয়ে বড় ও প্রধান শাখা

  • ১২ জন ইমামের প্রতি বিশ্বাস

  • ইরানে প্রচলিত

✅ ২. ইসমাইলি শিয়া

  • ৭ ইমাম পর্যন্ত বিশ্বাস

  • অনেকটাই দার্শনিক মতবাদে ঝুঁকেছে

✅ ৩. জায়দিয়া শিয়া

  • ৫ ইমাম পর্যন্ত গ্রহণ করে

  • ইয়েমেনে বেশি প্রচলিত


🌍 শিয়া মুসলমানদের বিশ্বব্যাপী অবস্থান

দেশ শিয়া মুসলমানের আনুমানিক হার
ইরান ৯০–৯৫% (শিয়া ইসলামের কেন্দ্র)
ইরাক ৬০–৭০%
আজারবাইজান ৬৫%
বাহরাইন ৬৫%
লেবানন ৩০–৪০%
পাকিস্তান ১৫–২০%
ভারত ১০–১৫%

🔍 শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে পার্থক্য

বিষয় সুন্নি শিয়া
নেতৃত্ব খলিফা নির্বাচিত ইমাম মনোনীত
আক্বিদা সাহাবাদের সকলকে সম্মান কিছু সাহাবার বিরোধিতা করে
হাদীস সংগ্রহ বুখারী, মুসলিম ইত্যাদি নিজস্ব শিয়া হাদীস
আশুরা ঐতিহাসিক দিন শোক ও মাতমের দিন
বিবাহনীতি স্থায়ী বিবাহ মুত’আ বৈধ বলে মানে

📚 শিয়া ইসলাম নিয়ে আরও পড়ুন

  • “Nahjul Balagha” – হযরত আলীর বাণী সংকলন

  • “Kitab al-Kafi” – শিয়াদের প্রধান হাদিস গ্রন্থ

  • কারবালা নিয়ে "Tears and Tributes" এবং “The Tragedy of Karbala”


🕯 উপসংহার: শিয়া ইতিহাস থেকে শিক্ষা

শিয়া ইসলাম শুধুই একটি ধর্মীয় মতবাদ নয়; এটি একটি আত্মত্যাগ, নেতৃত্ব, এবং ন্যায়বিচার-এর প্রতীক। কারবালার ঘটনা শিখিয়ে দেয়, সত্য ও ন্যায়ের জন্য কিভাবে আত্মত্যাগ করতে হয়। আজও শিয়া মুসলমানরা এই বার্তা বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, এবং আশুরার দিন সেই আত্মত্যাগকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন।


No comments:

Post a Comment